স্তন ক্যান্সার, কারণ ও প্রতিকার
স্তন ক্যান্সার, কারণ ও প্রতিকার
ডা. বশির আহমেদ তুষার
ফাইব্রো এডেনোমা এবং সিস্ট
মহিলাদের স্তনে গুটি হওয়া অথবা গুটিভাব অনুভূত হওয়া খুবই সাধারণ ঘটনা। এসব গুটির বেশির ভাগই কোনো ক্ষতিকর কিছু নয় অর্থাৎ এগুলো ক্যান্সার নয়।
মাসিকের পূর্বে স্তনে কিছু পরিবর্তন হয়। স্তনের টিস্যু নানা হরমোন দ্বারা প্রভাবিত হয় ফলে স্তনে চাকা অথবা গুটি ভাব বা ব্যথাও অনুভব করা যেতে পারে। নিজেদের স্তনের স্বাভাবিক পরিবর্তনগুলো মহিলাদের সবারই জানা প্রয়োজন। তাহলে অস্বাভাবিক কিছু হলে সহজে বোঝা যাবে। মাসিকের পূর্বে সাধারণত স্তনে ব্যথা এবং গুটি মনে হতে পারে। এ রকম অবস্থায় দুশ্চিন্তা না করে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়াই শ্রেয়। ডাক্তার আপনাকে পরীক্ষা করে দেখে প্রয়োজন হলে আরো কিছু টেস্টের ব্যবস্থা করতে পারেন। সাধারণত যেসব টেস্ট করা হয় সেগুলো হলো-
মেমোগ্রাম
মেমোগ্রাম স্তনের এক্স-রে। ৩১ বছরের বেশি বয়সে মেমোগ্রাম সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়। কারণ এই বয়সে স্তনের টিস্যু কম গ্লান্ডুলার থাকে এবং ছবি ভালো আসে।
ফাইন নিডেল অ্যাসপিরেশন সাইটোলজি
একটি সূক্ষ্ম সূচ দ্বারা স্তনের চাকা থেকে কিছু কোষ সরিয়ে নিয়ে তা অণুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষা করতে সাধারণত খুব একটা কষ্ট হয় না।
আলট্রাসাউন্ড
শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে এই পরীক্ষা করা হয়। ছোট মাইক্রোফোন জাতীয় যন্ত্র স্তনের ওপর ধরা হয়। স্তনের গুটি বা গুটি গুটি ভাব এই পরীক্ষায় ধরা পড়ে। সব বয়সের মহিলাদের জন্য এই পরীক্ষা অত্যন্ত কার্যকর। এই টেস্টগুলোর সাথে রোগীকে পরীক্ষা করে ডাক্তার নিশ্চিত হন যে স্তনে গুটি বা চাকা হয়েছে কিনা। এই পার্থক্যটা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফাইব্রোঅ্যাডেনোমা এবং সিস্ট এই দুটি সবচেয়ে অক্ষতিকর গুটি।
ফাইব্রোঅ্যাডেনোমা
১৫-৪০ বছরের মধ্যে ফাইব্রোঅ্যাডেনোমা হয়। স্তনে একটি শক্ত চাকা যা চাপ দিলে বেশ সহজে নড়াচড়া করে। আকৃতিতে বাড়তে অথবা কমতে পারে, সময়ে চাকাটা মিলিয়েও যেতে পারে। পরীক্ষা করে যদি ফাইব্রোঅ্যাডেনোমা নিশ্চিত হওয়া যায় তাহলে অপারেশন না করলেও চলে।
তবে রোগী যদি ৩০ বছরের বেশি বয়সী হয় তাহলে ফাইব্রোঅ্যাডেনোমা অপারেশন করে সরিয়ে ফেলার পরামর্শ দেয়া হয়। জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে ছোট অপারেশন করে গুটিটা সরিয়ে ফেলা হয়। এক্ষেত্রে শুধু একটা ছোট কাটা দাগ থাকে যা আস্তে আস্তে পরে মিলিয়ে যায়। অনেক সময় স্তনের অন্য জায়গায় ফাইব্রোঅ্যাডেনোমা নতুন করে আবারো হতে পারে।
সিস্ট
স্তনের সিস্ট একটি তরল পদার্থভরা থলি। হঠাৎ করে সিস্ট হলে ব্যথা হতে পারে। ৩০-৫০ বছর বয়সে সাধারণত এগুলো হয়। সিস্টের চিকিৎসাও খুব সহজ। একটি ছোট সূচ দিয়ে চাকা হতে পানিটা বা তরল পদার্থটা বের করে ফেলা হয়। কোনো জটিলতা না থাকলে গুটিটা সম্পূর্ণরূপে চলে যায়। যে মহিলাদের সিস্ট হয় তাদের পরবর্তীতেও স্তনের বিভিন্ন জায়গায় সিস্ট হতে পারে। অনেক সময় এসব সিস্ট অপারেশন করে সরানো হয়। ওষুধ দ্বারাও কোনো কোনো সময় চিকিৎসা করা প্রয়োজন হতে পারে। ফাইব্রোঅ্যাডেনোমা এবং সিস্ট ক্যান্সার নয় এবং এগুলো হলে ক্যান্সারের সম্ভাবনাকে বাড়ায় না। মহিলাদের নিজেদের স্তন সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। বিশ্বে প্রতি বছর ৫ লাখ নারী স্তন ক্যান্সারে মারা যায়। শুধু ব্রিটেনেই প্রতি বছর ৪৫ হাজার নারী এ রোগে আক্রান্ত হয়। আর বাংলাদেশে প্রতি বছর এ রোগে আক্রান্ত হয় ২২ হাজার নারী এবং মারা যাচ্ছে ১৭ হাজার নারী। এমন অবস্থায় চিকিৎসকরা বলছেন সচেতনতার মাধ্যমে ৯০% স্তন ক্যান্সার রোধ করা সম্ভব। এ রোগের সুসপষ্ট কারণ এখনো অজানা তবে পারিবারিক ইতিহাস থাকলে, বেশি মোটা হলে, ২০ বছরের আগে বিয়ে হলে, ৩০ বছরের পর প্রথম সন্তান জন্ম হলে, সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ালে, নিঃসন্তান থাকলে, বিড়ি-সিগারেট, তামাক সেবন, কম শারীরিক পরিশ্রম, দীর্ঘদিন উচ্চরক্তচাপে, বহুমূত্র রোগ। চাই আমার দেশের প্রতিটি নারী হবে সচেতন এবং কুসংস্কারমুক্ত, সুখী জীবনের মূলমন্ত্র সকলেরই জানা দরকার।
ম্যাস্টালজিয়া
অনেক নারীই কোনো না কোনো সময়ে স্তনের ব্যথা অনুভব করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই অবস্থাকে ম্যাস্টালজিয়া বলে। হরমোন নির্ভরশীল পরিবর্তন এর কারণ। বুকে ব্যথার সাথে সাথে চাকা বা গুটি অনুভব হয়। এর কারণে মহিলারা ব্যথায় কষ্ট পান এবং অনেক দুশ্চিন্তা করেন। আসলে এটা খুব মারাত্মক কিছু নয়। তবে দুশ্চিন্তার বড় কারণ হতে পারে হরমোন নির্ভরশীল পরিবর্তন। সাধারণত ৫৫ বছর বয়সের নিচে এবং যেসব মহিলাদের মাসিকের আগে ব্যথা ও গুটির সমস্যা বাড়ে। মাসিকের পর কমে যায়। রক্তে নানা হরমোন লেভেল স্তনের টিস্যুকে প্রভাবিত করে। কোনো কোনো সময় ব্যথা খুব তীব্র হয় এবং সব সময় থাকে। এই ব্যথা হাতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। অনেকে ভাবেন ক্যান্সারের সম্ভাবনা। আসলে এটা ক্যান্সার নয়। জেনে রাখুন ক্যান্সারের কারণে ম্যাস্টালজিয়া হয় না। স্তনের গুটি বা ম্যাস্টালজিয়া হলে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। তিনি পরীক্ষা করে অন্য কোনো কারণে অসুবিধা হচ্ছে কি না বলতে পারেন। অন্য কোনো কারণে গুটি বা ব্যথা হয়েছে কি না তা বের করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
চিকিৎসা
একবার যখন এইচডিসি রোগ ধরা পড়ে তখন রোগিণীকে আশ্বস্ত করা যায়। রোগীর যদি উপসর্গ খুব বেশি না থাকে কোনো ওষুধ পত্রের প্রয়োজন হয় না। বেশির ভাগ মহিলার জন্য এটাই প্রযোজ্য।
এইচডিসি নিজে নিজে ভালো হয়ে যায় তবে কয়েক মাস সময় লাগে। যদি উপসর্গের জন্য বেশি কষ্ট পেয়ে থাকেন তাহলে বিভিন্ন রকমের চিকিৎসা করে দেখা যেতে পারে। যেমন-
ইভিনিং প্রিমরোজ অয়েল ক্যাপসুল
অনেক সময় দেখা গেছে ইভিনিং প্রিমরোজ অয়েল ক্যাপসুল খেলে স্তনের ব্যথা এবং চাকা ও শক্তভাব কমে যায়। বিশেষ করে মাসিকের পূর্বে যখন এসব উপসর্গ বাড়ে। সব মহিলার ক্ষেত্রে এটা কাজ নাও করতে পারে এবং এটা কাজ করতে কয়েক সপ্তাহ লাগে।
কেফিন
চা অথবা কফি বেশি খেলে এইচডিসি বাড়তে পারে। চা বা কফি (যেগুলোতে কেফিন থাকে) খাওয়া কমিয়ে দিলে অনেক সময় এইচডিসি ভালোর দিকে যায়।
দুশ্চিন্তা
দুশ্চিন্তায় মাথাব্যথা, ঘুম কম হওয়া, বিরক্ত হওয়া এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ার সাথে সাথে ম্যাস্টালজিয়া বাড়তে পারে। এই কারণে স্ট্রেস কমানো প্রয়োজন। রিলাক্সেশন করায় উপকৃত হতে পারেন।
ব্রা
সঠিক ফিটিং ব্রা অনেক সাহায্য করে। উল্লেখ্য আমাদের দেশের মেয়েরা ৯০%ই বেঠিক সাইজের ব্রা পরেন।
হরমোন থেরাপি
যদি উপসর্গ খুব বেশি হয় তাহলে হরমোন থেরাপি দেয়া যেতে পারে। মনে রাখবেন হরমোন খাবার সময় গর্ভধারণ করা যাবে না। এই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। তাই রোগীর খুব কষ্ট না থাকলে দেয়া হয় না।
জেনে রাখুন এইচডিসি স্তনের ক্যান্সার নয় এবং আপনার স্তন ক্যান্সারের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয় না। তবে এইচডিসি হলে যে আপনার স্তনের ক্যান্সার হতে পারে না তা নয়। সে জন্য নতুন কোনো উপসর্গ বা নতুন কোনো গুটি দেখা দিলে আপনি অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।
স্তন ক্যান্সার কীভাবে প্রতিরোধ করবেন?
মাসে অন্তত একবার নিবিড় পর্যবেক্ষণের দ্বারা স্তনের যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ এবং অনুভব করা যায়। স্তনের আকার বা গড়নের পরিবর্তনের পেছনে বহু কারণ থাকতে পারে, যার বেশির ভাগই ক্ষতিকর কিছু নয়, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে স্তনের পরিবর্তনই মূলত স্তন ক্যান্সারের প্রথম এবং প্রাথমিক চিহ্ন হিসেবে কাজ করে।
স্তনের সাধারণ পরিবর্তন
সাধারণত নারী মেনোপজের আগে স্তনের দুধ দানকারী টিস্যুসমূহ ঋতু শুরুর আগে আগে কার্যক্ষম হয়ে ওঠে। কোনো কোনো মহিলার ক্ষেত্রে স্তন হয় নরম অথবা বগলের কাছাকাছি জায়গায় স্তনে গোটার মতো হতে পারে। সাধারণত মহিলাদের ঋতু বন্ধের বছরখানেক আগে স্তনের এ ধরনের পরির্তন স্বাভাবিক। আবার মৃগীরোগ বা হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত মহিলাদের স্তনে এ সকল পরিবর্তন মাসে মাসে দেখা দিতে পারে এবং ঋতুচক্র শেষ হলেই স্তন আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। কাজেই স্তন পর্যবেক্ষণের সবচেয়ে ভালো এবং উপযুক্ত সময় হচ্ছে প্রতি মাসে ঋতুচক্র শেষ হওয়ার ঠিক পরপর। এমনকি মহিলাদের মেনোপজের পরও প্রতি মাসের ওই একই তারিখে স্তন পর্যবেক্ষণ করা উচিত। তবে মনে রাখা জরুরি এ পর্যবেক্ষণ মাসে একবারের বেশি করা ঠিক নয়। এতে করে স্তনের ছোটখাট পরিবর্তন পরিষকার ও সঠিকভাবে লক্ষ করা যায় না।
কীভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন
- প্রথমত শরীরের ওপরের অংশ অনাবৃত করে আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে। যে কোনো একটি স্তন একটি থেকে অপরটি আকারে বড় বা ছোট হতে পারে। এটি একেবারে স্বাভাবিক।
- এরপর সামনের দিকে ঝুঁকে লক্ষ করতে হবে স্তন দুটির একটি অপরটির চেয়ে ভিন্নভাবে দোলে বা নড়ে কি না। পরবর্তীতে দুটো স্তনই ধরে উপরের দিকে তুলে ধরতে হবে। এক্ষেত্রে লক্ষ করতে হবে স্তনের শীর্ষের চামড়ায় কোনো গর্ত বা খাঁজ সৃষ্টি হয় কি না।
- এরপর স্তন ধরে চাপ দিয়ে ছেড়ে দিয়ে কয়েক সেকেন্ড পরই পুনরায় চাপ দিতে হবে এবং এক্ষেত্রে লক্ষ করতে হবে স্তনের পুরো এলাকাজুড়ে কোথাও কোনো গর্ত, খাঁজ বা সমতল কিছু সৃষ্টি হয় কি না।
- পাশাপাশি অবশ্যই লক্ষ করতে হবে স্তনবৃন্ত দুটি ভিন্ন দুমুখী কিনা অথবা একটি আরেকটির চেয়ে ভেতরে ঢুকানো কি না।
- দু হাত মাথা বরাবর সোজা উঁচু করে ধরে লক্ষ করতে হবে। এ অবস্থায় স্তন দুটির যে কোনো একটির আকারে পরিবর্তন ঘটায় কি না।
- পর্যবেক্ষণের যদি সব ক্ষেত্রেই উত্তর হ্যাঁ হয় তবে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
স্তন সমস্যায় যখন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে
অনুভূতি
স্তনে যদি কোনো বাজে অস্বস্তিকর ব্যথা বিশেষ করে যে কোনো একটি স্তনে ব্যথা হয় এবং ব্যথার ধরন যদি নতুন এবং টানা বা ক্রমাগত হয়।
স্তনবৃন্তের পরিবর্তন
স্তন থেকে যদি কোনো ধরনের তরলজাতীয় পদার্থ নির্গত হয়, যা দুধ নয় অথবা যদি স্তনবৃন্ত থেকে রক্তক্ষরণ হয় বা সেখানে নীল আর্দ্র এলাকার সৃষ্টি হয় যা সহজে আরোগ্যযোগ্য নয়।
দুটি স্তনের আকারে যদি পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়, বিশেষ করে বাহু নড়াচড়ার ফলে এবং স্তন উঁচু করে ধরলে সৃষ্টি হয়। স্তনের কোনো একটি অংশ যদি অপর স্তনের একই জায়গা থেকে আলাদা হয় অথবা স্তনে যদি কোনো গোটা বা পুরু মোটা এলাকা সৃষ্টি হয় অথবা স্তনে যদি কোনো থলথলে এলাকা সৃষ্টি হয় এবং যদি তা নতুন হয়।
ছোটখাটো পরিবর্তনের বেলায় সতর্ক থাকা উচিত। ছোটখাটো এসব পরিবর্তন হয়তো অল্পমাত্রার ক্যান্সার নির্দেশ করতে পারে। এক্ষেত্রে সময়মতো চিকিৎসা চমৎকার ফলাফল দেবে।
চিকিৎসকে সবকিছু খুলে বলা উচিত। কারণ তিনিই স্তনের পর্যবেক্ষণ সর্বোৎকৃষ্ট উপায়ে করতে সক্ষম। বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রে ম্যামোগ্রাম নামক স্তনের জন্য বিশেষ ধরনের এক্স-রের মাধ্যমে ক্যান্সারের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়েও শনাক্ত করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে চিকিৎসকের কাছে সময় নিয়ে সবকিছু খুলে বলার মানে কারো সময় নষ্ট করা নয়। সতর্ক ও আন্তরিক হলে এর প্রতিরোধ ও আরোগ্য সম্ভব।
[ ভাল লাগলে পোস্ট এ অবশ্যই লাইক দিবেন , লাইক দিলে আমাদের কোনো লাভ অথবা আমরা কোনো টাকা পয়সা পাই না, কিন্তু উৎসাহ পাই, তাই অবশ্যই লাইক দিবেন । ]
Leave a comment